একবিংশ শতাব্দীর বিপ্লবঃ বায়োইনফরম্যাটিক্স
বায়োইনফরম্যাটিক্স এর বাংলা হচ্চে জৈবতথ্য বিজ্ঞান। ইংরেজিতে একে বলা হয়েছে এক ধরণের interdisciplinary field। অর্থাৎ, জৈবতথ্য বিজ্ঞানে জীববিজ্ঞানের সাথে আরও কতগুলো বিষয় সংশ্লিষ্ট রয়েছে। সেই বিষয়গুলো হচ্ছে প্রথমতঃ কম্পিউটার বিজ্ঞান, দ্বিতীয়তঃ গাণিতিক অ্যালগরিদম ও পরিসংখ্যান। বায়োইনফরম্যাটিক্সে যে জীববিজ্ঞানের কথা বলা হচ্ছে তা মূলতঃ অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, ইংরেজিতে যাকে মলিকুলার বায়োলজি বলা হয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের সাথে কম্পিউটার বিজ্ঞানের সম্পর্কটা আসলে কী?
আমার বায়োইনফরম্যাটিক্স সম্পর্কে জানার ও জানানোর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে কয়েকটি কারণ থেকে। আমি নিজেই মৌলিকভাবে বায়োলজিক্যাল সাইন্সে পড়াশুনা করেছি ভার্সিটি জীবনে। কিন্তু কম্পিউটার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ পোষণ করতাম সবসময়। প্রতিদিন গড়ে অন্ততঃ পাঁচ ঘণ্টা আমার কম্পিউটারের সামনে বসে ব্যয় হত এবং সেই সময়টা এখন প্রফেশনাল জীবনে আরও অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বায়োলজিক্যাল সাইন্সে পড়া একজন শিক্ষার্থীর কম্পিউটারের সামনে বসে সময় নষ্ট করার যৌক্তিকতা কতটুকু। শুরুর দিকে আমি কোন প্রকার যুক্তি দেখিনি। কম্পিউটারে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা ভালো লাগে শুধু এতটুকুই বলতে পারতাম। বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্সের ক্লাসে স্যার আমাদেরকে বায়োইনফরম্যাটিক্স সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য দিয়েছিলেন । তাতে অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের সাথে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক সম্বন্ধে জানতে পারি। কিন্তু ব্যাপারটা ছিল অনেকটাই ধোঁয়াটে। এদিকে একটা প্রাইভেট প্রোগ্রামে উচ্চমাধ্যমিকের আইসিটি শিক্ষক হিসেবে লেকচার দেয়া শুরু করেছিলাম। যদিও আইসিটি সম্পর্কে বেশ কিছু নিবন্ধ ও গ্রন্থ পড়েছি তথাপি উচ্চ মাধ্যমিকের আইসিটি বইটি আমার কাছে নতুন ছিল। সুতরাং, বইটি উল্টিয়ে পালটিয়ে দেখতে হল। বইটির কোন একটা জায়গায় বায়োইনফরম্যাটিক্স সম্পর্কে একটা বর্ণনা দেখতে পেলাম, স্যার আমাদের ক্লাসেই যেটার সম্পর্কে অল্প কিছু বলেছিলেন। ভাবতেই অবাক লাগলো যে আজকে যেখানে উচ্চমাধ্যমিকে কলেজের ছাত্র বায়োইনফরম্যাটিক্স সম্পর্কে পড়ছে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সত্ত্বেও ওই বিষয় সম্পর্কে আমার ধারণা প্রায় শুন্য। সুতরাং বায়োইনফরম্যাটিক্সের সাধারণ জ্ঞানকে ঝালাই করতে হল।
বিজ্ঞানীরা সারাটা জীবন মানব কল্যাণের জন্য বিভিন্ন গবেষণা কর্ম চালিয়ে যান। অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে তৈরি বহুমূল্য এই গবেষণা কর্মগুলি বিজ্ঞান বইয়ের পাতাকে প্রতিনিয়ত ভারী করে তোলে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকরা অনেক সময় অজান্তেই পূর্বে তৈরি হয়ে যাওয়া গবেষণা কর্মে শ্রম দিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেলেন। পৃথিবীর এক প্রান্তের গবেষণার ফল অন্য প্রান্তের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে আবিষ্কারে খুব দ্রুতই বিপ্লব নিয়ে আসা সম্ভব হয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন এমন একটি টুলের যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষণার মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করতে পারে। এই টুলটিই প্রদান করে বায়োইনফরম্যাটিক্স। বিজ্ঞানী আর গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর গবেষণার ফলে যে বহুমূল্যবান তথ্য প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে সেই সকল তথ্যের মধ্যে বায়োইনফরম্যাটিক্স যে আন্তঃসংযোগটি প্রদান করে তার ফলে গবেষণাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের জন্য অনুপ্রাণ বিজ্ঞানে তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগকে বায়োইনফরম্যাটিক্স বলা যেতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির এই প্রয়োগ মূলত বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল ডাটা এনালাইসিসকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বায়োলজিক্যাল ডাটার পরিধি মূলত ডিএনএ, জীন, অ্যামিনো এসিড, প্রোটিন, নিউক্লিক এসিড এগুলোর মধ্যেই মোটামুটি ভাবে সীমাবদ্ধ থাকে।
উপরে যতটুকু বলা হল আমার মনে হয় না তাতে বায়োইনফরম্যাটিক্সের প্রাথমিক ধারণা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে। বায়োইনফরম্যাটিক্সের প্রয়োগ যেহেতু কৃষি, মাৎস্য ও পশু চিকিৎসা খাতেই সর্বাধিক, সুতরাং এগুলোর মাধ্যমেই বিষয়টি উদাহরণের সাহায্যে বোঝানো যেতে পারে। ধরুন, কোন এক প্রকার ভাইরাস কোন কৃষিজ পণ্য, বা কোন মাছের মধ্যে কিংবা কোন গবাদি পশুতে মহামারী আকারে ছড়ায়। সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে পেপটাইড ভ্যাক্সিন তৈরি করা প্রয়োজন। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে শতাধিক পেপটাইড সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে হয়ত মাত্র তিন চারটি পেপটাইড ভ্যাক্সিন হিসেবে কাজ করতে পারে। এখন এই তিন চারটি পেপটাইডকে খুঁজে পেতে শতাধিক পেপটাইডের উপর গবেষণাগারে পরীক্ষা চালাতে হয়। যাতে লক্ষ লক্ষ টাকা, পরিশ্রম আর সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কারণ এখানে শতাধিক উপাদান থেকে মাত্র তিন চারটি উপাদানকে বহুমূল্যবান রিয়াজেন্টেন মাধ্যমে পরীক্ষা করে খুঁজে বের করতে হবে। যা যথেষ্ট সময় আর শ্রম সাপেক্ষ। কিন্তু এই কাজটিই যদি কোন ড্রাই ল্যাবে কোন প্রকার রিয়াজেন্টের ব্যবহার ছাড়াই স্বল্প সময়ে করা যেতে পারত তবে গবেষণার কাজ স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত। এজন্য গবেষকগণ এমন একটি টুল উদ্ভাবনের কথা চিন্তা করলেন যা এমন একটি ইন্টারনেট ভিত্তিক ড্রাই ল্যাব তৈরি করবে যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকগণ গবেষণা কাজ চালাতে পারেন। আর তা সম্ভবও হল। গবেষকগণ এমন কতগুলো সফটওয়্যার ডেভ্লপ করে ফেললেন যেখানে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল ডাটার বিশ্লেষণ করে ঐ ডাটা সমূহের ত্রিমাত্রিক মডেলিং, সিমুলেশন বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। এ ধরণের টুলের সাহায্যে ড্রাই ল্যাবে কোন ধরণের রিয়াজেন্টের সাহায্য ছাড়াই স্বল্প সময়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসে থাকা গবেষকদের সহায়তায় উপরের উদাহরণের মত শতাধিক পেপটাইড থেকে সম্ভাব্য দশটি পেপটাইড খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। এভাবে শতাধিক পেপটাইড নিয়ে ওয়েট ল্যাবে কাজ করা ছাড়াই এই দশটি মাত্র পেপটাইড নিয়ে কাজ করে দশ গুণ কাজের সময় কমিয়ে, শ্রম আর অর্থ সাশ্রয় করে দেয় যে পদ্ধতিটি সেটিই বায়োইনফরম্যাটিক্স।
আমরা মোটামুটি সকলেই সংকরায়ন কথাটি সম্পর্কে অবগত রয়েছি। সংকরায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যেটি একুশ শতকের এই ভয়াবহ পারিবেশিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার মাধ্যমে জনবহুল বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত রেখেছে। সংকরায়ন প্রক্রিয়ায় একাধিক গুণাবলী সম্পন্ন জাত থেকে ঐ সকল গুণের নিয়ন্ত্রণ করে যে জীনগুলি সে জীনগুলিকে একটি নির্দিষ্ট জাতের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। এই অত্যন্ত জটিল কাজটিকে সহজ করে দেয় বায়োইনফরম্যাটিক্স। তাই এখন গবেষকরা কম খরচে, পরিবেশের কম ক্ষতি করে বেশি উৎপাদনের পদ্ধতিটি খুঁজে বের করার জন্য বায়োইনফরম্যাটিক্সের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বায়োইনফরম্যাটিক্স কৃষিজ উৎপাদন খাতে দুনিয়াকে নেতৃত্ব দেবে।
১৯৫০ সালের শুরুর দিকে ফ্রেডারিক সেঙ্গার ইনসুলিনের সিকুয়েন্স সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। ঠিক তখনই বিশ্ব প্রোটিনের সিকুয়েন্স সম্পর্কে সর্বপ্রথম অবগত হওয়ার মাধ্যমে অনুপ্রাণ বিজ্ঞানে কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বায়োইনফরম্যাটিক্সের মাধ্যমে প্রোটিনের একাধিক সিকুয়েন্সের মধ্যে তুলনা হয়ত সর্বপ্রথম করেছিলেন আমেরিকান মহিলা রসায়নবিদ ডঃ মার্গারেট ওয়াকলে ডেহফ্। যাকে ন্যাশনাল সেন্টার ফর্ বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন(NCBI)-এর ডিরেক্টর ডেভিড লিপম্যান বায়োইনফরম্যাটিক্সের মাদার এবং ফাদার হিসেবে অভিনন্দিত করেছেন। ডঃ ডেহফ্ ডেটাবেজের মধ্যে ডেটা টেবিলের শুরুর দিকের কোন প্রোটিনের সিকুয়েন্স তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সিকুয়েন্স অ্যালাইনমেন্ট ও অনুপ্রাণের বিবর্তনের ধারণা প্রদানের মাধ্যমে বায়োইনফরম্যাটিক্সের আলোকবর্তিকা হন।
বায়োইনফরম্যাটিক্সের মাধ্যমে আজকাল অনেক জটিল প্রক্রিয়া সম্পাদিত হচ্ছে। যেমনঃ সিকুয়েন্স অ্যালাইনমেন্ট, কাঙ্ক্ষিত জীন খুঁজে বের করা, জিনোম অ্যাসেম্বলি, ড্রাগ ডিজাইন করা, প্রোটিনের গঠন অ্যালাইন করা, প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে পূর্ব ধারণা দেয়া ইত্যাদি। যে ওপেন সোর্স সফটওয়ারের মাধ্যমে বায়োইনফরম্যাটিক্সের এই জটিল কাজগুলো সম্পাদনা করা হচ্ছে সেগুলি হচ্ছে বায়ো কনডাক্টর, বায়ো-পার্ল, বায়ো-পাইথন, বায়ো-জাভা, বায়ো-জাভাস্ক্রিপ্ট ইত্যাদি। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, এই সফটওয়্যারগুলো যারা ডেভ্লপ করেছেন তাঁরা একাধারে বায়োলজিস্ট এবং প্রোগ্রামার। অত্যন্ত অবাক হওয়ার বিষয় যে, পৃথিবী আজ কোথায় চলে গিয়েছে আর আমরা এ অবধি কোথায় পড়ে আছি!