যে ১৫ উপায়ে ভালো থাকবে আপনার ল্যাপটপ
একইসাথে এক ব্রান্ডের ল্যাপটপ কিনেছিল সুমন আর রাজিব। সুমনেরটা ছিল কোর আই ফাইভ প্রসেসরের ল্যাপটপ সেজন্য দাম পড়েছিল একটু বেশি। রাজিবের বাজেট কম ছিল তাই সে নিয়েছিল কোর আই থ্রি প্রসেসরের ল্যাপটপ। তবে এক বছর ঘুরতেই দেখা গেল সুমন তার দামি ল্যাপটপ নিয়ে বেশ ঝামেলাতে আছে। তার ল্যাপটপের গতি বেশ কমে গেছে, কোন কমান্ড দিলে বা ক্লিক করলে সেটা দেরি করে কাজ করে, পিসি হঠাৎ হঠাৎ রিস্টার্ট নেয়, স্ক্রিন ব্ল্যাক-আউট হয় মাঝে মাঝেই। সুমন এরমাঝেই দু’বার ল্যাপটপ ঠিক করিয়েছে, আর এখন তো সে ভীষণ বিরক্ত! ল্যাপটপটা সে একরকম ফেলেই রাখে, ময়লা দাগ আর ধুলো জমে থাকে তার ল্যাপটপে। ওদিকে সেই ঠিক এক বছর পর রাজিবের ল্যাপটপ কিন্তু কেবল চলছে না একরকম দৌঁড়াচ্ছে; তার ল্যাপটপ দেখে মনেই হয় না যে এটা এক বছর আগে কেনা হয়েছে! সমস্যা যে রাজিবের হয় নি তা কিন্তু নয় তবে সেজন্য তাকে সার্ভিসিং-এর কথা ভাবা লাগে নি। সেসব ছোটখাটো ট্রাবলশ্যূটিং সে নিজেই করেছে। এখানে সেলসম্যানের ভুলে রাজিব যেমন কম দামে ভালো ল্যাপটপ পায় নি ঠিক তেমনি সুমনও কিন্তু বেশি খরচ করে ঠকে নি। মূল সমস্যা এখানে হয়েছে কম্পিউটারের রক্ষণাবেক্ষণে ।
সুমন ও রাজিবের মতোই ল্যাপটপ ব্যবহার করছেন কিন্তু সমস্যাতে পড়েন নি এরকম মানুষ সম্ভবত বিরল। অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মতো ল্যাপটপও সমস্যার বাইরে নয়। তবে অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় যে এসব সমস্যার মূলে যতটা না যন্ত্রাংশের দূর্বলতা তার চাইতে বেশি থাকে ব্যক্তিগত অসচেতনতা। সেজন্য চলুন জেনে নেই কীভাবে আপনি আরো ভাল রাখতে পারবেন আপনার নিত্য-ব্যবহার্য ল্যাপটপটিকে:
১। তরল পদার্থ থেকে সাবধান
যে কোন ধরণের তরল পদার্থ যেমন: খাবার পানি, চা, কফি, সোডা, জুস ল্যাপটপের কাছ থেকে দূরে রাখুন। অধিকাংশ সময় এসব পান করতে গিয়ে ল্যাপটপের উপরে গিয়ে পড়ে দূর্ঘটনা ঘটে, কারণ এসব তরল পদার্থ ল্যাপটপের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ বিকল করে দিতে পারে।
২। খাওয়ার সময় ল্যাপটপে কাজ নয়
খেতে খেতে ল্যাপটপে সিনেমা কিংবা নাটক দেখার অভ্যাস অনেকেরই আছে। তবে এরকম না করাই ভাল, ল্যাপটপের কাছে কিংবা উপরে খাবার রেখে খেলে ল্যাপটপ তো নোংরা হবেই উপরন্তু খাদ্যকণা ল্যাপটপের ফাঁক-ফোকরে আটকে যেতে পারে। এতে পরবর্তিতে শর্ট-সার্কিট হয়ে কম্পিউটার ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
৩। পোষা প্রাণীটি যখন প্রিয় নয়
আপনার হয়তো প্রিয় বিড়াল কিংবা কুকুর রয়েছে। ল্যাপটপে কাজের সময় আপনার সেই পোষা প্রাণীটির কাছ থেকে দূরে থাকুন কারণ এসব পোষা প্রাণীর লোম ও চুল খুব সহজেই ল্যাপটপের ভিতরে ঢুকে যেতে পারে।
৪। ডিসপ্লে, কীবোর্ড নিয়ে চাই সর্তকতা
ল্যাপটপের পর্দা খুবই স্পর্শকাতর একটি অংশ তাই কলম বা পেন্সিল দিয়ে সেটা ছোঁবেন না, স্ক্রিন ও স্ক্রিনের কোণা পরিষ্কার রাখার জন্য পরিষ্কার নরম কাপড় ও পুরাতন ব্রাশ ব্যবহার করা উচিত। টাইপিং বোর্ডের মাঝের সরু জায়গার জন্য ‘কটন বাড’ অথবা ‘কম্প্রেসড এয়ার ক্যান’ ব্যবহার করুন। একই কারনে ল্যাপটপের ডিসপ্লে ধরে টানাটানি করা কিংবা ল্যাপটপের উপরে ভারী কোন জিনিস যেমন- বই রাখা উচিত নয়, এতে ল্যাপটপের স্ক্রিন বা কীবোর্ডের ক্ষতি হতে পারে। ল্যাপটপে টাচ স্ক্রিন থাকলে ‘স্ক্রিন প্রটেক্টর’ আর কী-বোর্ড এর জন্য ‘কী-বোর্ড প্রটেক্টর’ ব্যবহার করুন।
৫। ল্যাপটপের আসল দুশমন!
আর্দ্রতা, ধুলোবালি এসব হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের প্রধান শত্রু! আর সেজন্য ল্যাপটপ ব্যবহারের সময় আপনার নিজেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ভেজা কিংবা অপরিষ্কার হাতে ল্যাপটপের ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন; কম্পিউটার ব্যবহারের জায়গাটিও সর্বদা পরিচ্ছন্ন রাখুন।
৬। ল্যাপটপের জন্য ব্যাগ
ল্যাপটপ নিয়ে বাইরে যেতে হলে সেটা অবশ্যই ব্যাগে ভরে নিন। এতে করে বাইরের ধুলোবালি ছাড়াও হঠাৎ আঘাত ব ঘষা লাগা থেকে আপনার কম্পিউটারটি রক্ষা পাবে। এছাড়া ড্রাইভ থেকে সিডি কিংবা ডিভিডি এসব বের করে রাখার কথা ভুলবেন না।
৭। কম্পিউটার ভাইরাস
ধুলো-বালির মতো বাইরে থেকে আসা ম্যালওয়্যার, কম্পিউটার ভাইরাস এসবও কম্পিউটারের গতি কমিয়ে দেয়, ক্ষতি করে। আপনি প্রায় প্রতিদিন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যাচ্ছেন, এটা সেটা ডাউনলোড করছেন, পেনড্রাইভের মাধ্যমে ফাইল আদান-প্রদান করছেন আর এসবের মাধ্যমে কম্পিউটারে খুব সহজেই ভাইরাস ঢুকে যাচ্ছে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার হলো সবথেকে ভালো সমাধান; আপনার মূল্যবান কম্পিউটার যন্ত্রাংশের নিরাপত্তায় এজন্য একটি ভালো মানের প্রিমিয়াম অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন আর সেটিকে ‘আপডেটেড ’ রাখুন।
৮। ডিফ্রাগমেন্টেশন এন্ড অপ্টিমাইজেশন
কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ড্রাইভ গুলোর কমপক্ষে ২০% জায়গা ফাঁকা রাখুন; ড্রাইভগুলো প্রায় প্রায়ই ‘ডিফ্রাগমেন্ট’ করুন, অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, বড় ফাইল জমিয়ে রাখবেন না। এতে কম্পিউটার সহজে স্লো হবে না। ডিফ্রাগমেন্টেশন এন্ড অপ্টিমাইজেশনকরার জন্য নিচের ফ্লো-চার্টটি অনুসরণ করুন:
৯। টেম্পোরারী ফাইল
কম্পিউটারে জমা হওয়া টেম্পোরারি ফাইল মুছে ফেলুন। এজন্য নিচে দেখানো পদ্ধতিটি কাজে লাগান:
১০। ল্যাপটপের হঠাৎ গরম হয়ে যাওয়া উপেক্ষা করবেন না
কম্পিউটার চলাকালীন সময়ে সেটা উত্তপ্ত হতে থাকে; কম্পিউটারের এগজস্ট ফ্যান এই অতিরিক্ত তাপকে গরম হাওয়া হিসেবে বাইরে বের করে দেয়। বিছানার মতো নরম কোন জায়গায় ল্যাপটপ রেখে ব্যবহার করলে এগজস্ট ফ্যানের পোর্ট বিছানায় চাপা পড়ে ফলে গরম বাতাস বের হতে পারে। এতে ল্যাপটপের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এজন্য ল্যাপটপ সব সময় ‘সলিড সারফেস’ বা শক্ত কোন জায়গা বেছে নিন। একই কারনে রান্নাঘর কিংবা গাড়ির ভিতরে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করা ঠিক নয় কারণ এসব জায়গার তাপমাত্রা স্বাভাবিক কক্ষ-তাপমাত্রার চাইতে অনেক বেশি থাকে।
১১। সি-ড্রাইভ সমাচার
আপনার ল্যাপটপের সি-ড্রাইভটি যতটা সম্ভব ফাঁকা রাখুন, সেজন্য অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার আনইনস্টল করে দিন এবং মাঝে মাঝে সি-ড্রাইভের ‘ডিস্ক ক্লিন-আপ’ করুন এতে অনেক জায়গা ফাঁকা হবে। এজন্য নিচের ফ্লো-চার্টটি অনুসরণ করুন:
১২। ল্যাপটপ চার্জিং-এর সাত-সতের
ল্যাপটপ চার্জ দেওয়ার মতো সেটাকে চার্জ না দেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে যেটা অনেকেই জানেন না। প্রায় অনেকেই ল্যাপটপ চার্জে রেখে সারাক্ষণ কাজ করেন। একসময় দেখা যায়, সেই ল্যাপটপ আর ভালোকরে চার্জ ধরে রাখতে পারছে না, এজন্য লোডশেডিং হলে কিংবা দূর গ্রামাঞ্চলে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে গেলে বাঁধে ভীষণ সমস্যা! ল্যাপটপের ব্যাটারি সাধারণত লিথিয়াম পলিমার ধরণের হয়, অতিরিক্ত চার্জিং-এর ফলে ব্যাটারি সেলগুলো ফুলে উঠে আর ধীরে ধীরে চার্জ ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এজন্য ব্যাটারি ৮০ শতাংশ চার্জ দিয়ে ৪০ শতাংশ খরচ করে আবার চার্জিং করা উচিত। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে এভাবে ব্যাটারির চার্জ হওয়া আর চার্জ খালি হওয়ার ঘটনাটি নিয়মিত ঘটলেই কেবল ব্যাটারি সবথেকে ভালো থাকে।
১৩। চার্জিং-এর সময়ে সাবধানতা
ল্যাপটপের পাওয়ার কর্ড ধরে টানাটানি করবেন না, খেয়াল রাখবেন যে চার্জ দেওয়ার সময় পাওয়ার কর্ডটি যেন চেয়ারের পায়ার নিচে চাপা না পড়ে। এছাড়া চার্জিং স্লটটি মাঝে মাঝেই পুরনো ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত।
১৪। ডেস্কটপ বনাম ল্যাপটপ
ল্যাপটপকে ডেস্কটপের মতো দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহার না করাই ভালো; এতে ব্যাটারীর কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। কাজ শেষে ল্যাপটপ ‘শাট ডাউন’ বা বন্ধ করে থাকুন। কাজের মাঝে স্বল্প বিরতির সময় ‘স্ট্যান্ডবাই’ বা ‘স্লিপ’ মোড ব্যবহার করুন, ল্যাপটপে ডার্ক-থিম ব্যবহার করতে পারেন, এতে ব্যাটারির চার্জ সাশ্রয় হবে।
১৫। ব্যাকআপ
কথায় বলে, সাবধানতারও নাকি মার নেই! এতোকিছু মানার পরও যেকোন দূর্ঘটনায় ল্যাপটপ ক্ষতিগ্রস্ত হতেই পারে। তাই ল্যাপটপে থাকা আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য অবশ্যই সেগুলোর ব্যাকআপ রাখবেন। পরবর্তিতে ল্যাপটপ ঠিক করা গেলে কিংবা নতুন ল্যাপটপ নিলে যেন সেগুলো নিয়ে আবার কাজ করা যায়।
লিখেছেনঃ জ্যোতির্ময় পোদ্দার সাগর।